

দেশে সৎ লোকের অভাব দেখা দিয়েছে বলে প্রতিনিয়তই নাগরিকদের অভিযোগ। এই একটিই নয়, রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ অনেক।
তারা জনগণের টাকা দিয়ে বাড়ি বানান, গাড়ি হাঁকান, আরাম-আয়েশ করেন। শোষণ-শাসন দিয়ে ক্ষমতাকে একচেটিয়াভাবে দীর্ঘায়িত করে তোলেন বলে অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।
শেরেবাংলা এ কে এম ফজলুল হকের ওপর যারা পড়াশোনা করেছেন তারা নিশ্চই জানেন তিনি আমৃত্যু বৈপরীত্যের মাঝে বসবাস করেছেন।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে পরিচিত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন।
আরো পড়ুন: স্বাধীনতার অর্ধশত বছর : বিএনপির কাছে জনগণের চাওয়া
রাজনীতিবিদের কখনো খলনায়ক, কখনো বেইমান, কখনো দেশপ্রেমিক এসব উপাধি দেয়া হয়! কিন্তু তারপরও কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্না, মাহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে নিয়ে যাদের পড়ার সুযোগ হয়েছে তারাই বলতে পারবেন সমাজ-সংসারে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা সম্পর্কে।
মার্কিন ইতিহাসে জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রহাম লিঙ্কন থেকে বুশ, ওবামা, হিলারি, ম্যাককেইন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বশেষ নির্বাচনের সাধারণ ধারণা সামনেই আছে।
পশ্চিমা গণতন্ত্রের তীর্থ কেন্দ্র ও সূতিকাগার গ্রেট ব্রিটেনের দিকেও তাকানো উচিত নয় কি? রুশ বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, চেয়ারম্যান মাওয়ের গণচীনে বিপ্লব ছাড়াও বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর উত্থান, বিকাশ, পতন নখদর্পণে না হলেও অনেকের বোঝবার মতো জ্ঞান হয়েছে।
এছাড়া জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উত্থান, বিকাশ, পতন ও পর্ব দুটি বিশ্বযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ও আমাদের উপ-মহাদেশের রাজনীতি কী হয়েছে তা আমরা ভুলে যেতে পারি না। আফ্রিকাকে অন্ধকার মহাদেশ আখ্যায়িত করে লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার ইতিহাস অনেক বেশি তাজা। উপসাগরীয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরাক, আফগান, সিরিয়া, লিবিয়ার আগ্রাসন টাটকা ঘটনা।লাগোয়া দেশটির রাজনৈতিক চিত্র ও সাত বোনের কান্না, মিয়ানমার পরিস্থিতি, পাকিস্তানের অবস্থা, নেপালে মাওবাদের উত্থান, ভূটানের সিকিম, তামিম বিড়ম্বনার শ্রীলঙ্কার সম্পর্কে সবারই জানা।
আমাদের স্বাধীনতা উত্তর-পূর্ব রাজনীতি আমাদের শরীরে ঘামের গন্ধের মতো লেপ্টে রয়েছে। সত্তরের জনপ্রিয় শ্লোগান, আন্দোলন-সংগ্রাম,
মুক্তি যুদ্ধ-মুক্তিযুদ্ধত্তোর সময় লাল ঘোড়া, রক্ষীবাহিনী, ধানের ক্ষেতে ব্যালট বাক্স, স্বপ্নের হাতছানি বহুদলীয় গণতন্ত্র, স্ব-নির্ভর বাংলাদেশ, স্বৈরশাসকের আবির্ভাব, সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা, লগি-বৈঠা, সাজানো নির্বাচন, সংবিধান সংশোধন, একতরফা নির্বাচন ও দখলদারিত্ব সরকার ব্যবস্থা স্পষ্টত প্রতীয়মাণ।
এর আগে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল, সিপাহি-জনতার উত্থান, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব, সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসা, জনগণের মাঝে কর্মস্পৃহার জাগানোর, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যু, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের গদিচ্যুত, এরশাদের ক্ষমতা দখল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ, ৮৬’র নির্বাচন ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান। বুকে পিঠে লিখে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক-স্বৈরাচার নিপাত যাক’ দাবি নিয়ে নুর হোসেনের আত্মহুতী এসব স্মৃতি মুছে যায়নি।
এ তো ইতিহাস। মগজ থেকে এসব ইতিহাস ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়া যাবে না। তবে নাগরিকদের ভাবনার জগতে রাজনীতিবিদরা নিজেদের প্রয়োজনে জাতির সামনে বিভক্তিমূলক রাজনীতিকে লেবুর মতো কচলে তেতো করে তোলেন।
তাদের অভিযোগ, জাতিকে তো রাজনীতিবিদেরাই বিভক্ত করেন বা বিভক্ত করতে উৎসাহিত করেন। তাদের মতে, নেতারাই ভোগ করো, শাসন করো নীতি অনুসরণ করে ক্ষমতা ও শাসনকে দীর্ঘায়িত করার অভিসন্ধি লালন করেন। কিন্তু বাস্তবে কোনো সৎ সুশাসক দেশপ্রেমিক নেতা জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছেন তেমন ইতিহাস কারো জানা আছে বলে মনে হয় না।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন ১৯ দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ ভিত্তিতে। ১৯ দফার শেষ দফাটি আছে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি।
এত অভিজ্ঞতা নিয়ে নাগরিকরা রাজনীতিবিদ ও রাজনীতি নিয়ে উদার কেনো? উৎসাহী কেনো? মাইনাস প্লাসের ব্যাপারে বিরক্ত কেনো? প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। রাজনীতিকে দোষ দিয়ে আড়াল করার জন্য রাজনীতি ও রাজনীতিবিদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে কিছু ভালো কাজ খারাপ পদ্ধতিতে করতে গিয়ে জাতিকে ক্ষতিগ্রস্তই করা হয়েছে। দোষে-গুণের মানুষকে নিয়ন্ত্রণের আইন-আদালত লাগে, সংবিধান লাগে। যার যার পরিমিতিবোধ নিয়ে গণ্ডি মেনে কাজ করতে হয়।
নাগরিকরা কেউ কারো গোলাম নয়। কেউ কারো দণ্ড-মূলের মালিক বা প্রভু সাজতে পারে না। তাই মানুষের রাষ্ট্র মানুষের মাধ্যমে সংবিধান মতো নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত করতে হয়। জোরজবরদস্তি, অস্ত্র, আইনের খড়গ এবং জেল-জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে দিয়ে হয় না। মাইনাস-প্লাস অর্থহীন ও অনৈতিক।
অন্যায়ভাবে এত অধিক সময় দেশ চালাতে গিয়ে সরকার ভুলের পর ভুলেই করে যাচ্ছেন। কোনো কিছুর লাগাম টেনে ধরে রাখবার সম্ভব হচ্ছে না সুবিধাভোগীদের। বিধাতার বিধান ছাড়া মানুষ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে মানবিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হয়। বিয়ে ছাড়া সন্তান হয়, কিন্তু সেটি অবৈধ। একইভাবে বৈধ পন্থা ছাড়া কিছুই করা ঠিক নয়। নাগরিকরা একটা কথা জোর দিয়েই বলেন আইনের শাসন, সংবিধান এবং রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে আমলে নিতে।
অন্যথায় এমন একসময় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, যা থেকে উত্তরণের পথ খোঁজে পাওয়া কঠিন হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে দেশগুলো সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে তারা অনেক অসহিষ্ণু সময় পার করে আজকের পর্যায়ে এসেছে।
ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ইতিহাস চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের নয়। মার্কিন ইতিহাস কম সময়ের নয়। ওবামাকে মেনে নিয়ে হিলারিদের শতবর্ষের অনুশীলনের প্রয়োজন হয়েছে।
মার্কিনিদের সর্বশেষ নির্বাচন পরিস্থিতি বিশ্ববাসী দেখেছেন। তাই প্রতিষ্ঠান ভেঙে প্রতিষ্ঠানিকতা হয় না। আইন ভেঙে আইন তৈরি করা যায় না।
সংবিধান না মেনে সাংবিধানিক হওয়া যায় না। রাজনীতির চর্চা না করে রাজনীতিকে পরিশীলিত করা সম্ভব হয় না। ইনসাফ চাইলে ইনসাফ মানতে হয়।
দস্যু বাহরাম কিংবা রবিনহুডের মতো তস্কর সেজে বা ডাকাতি করে গরিবের বন্ধু সাজার মধ্যে দিয়ে রোমাঞ্চকর অনেক সুখানুভূতি আছে, কিন্তু নৈতিক বিচ্যুতির বিষয়টি ও মাথায় নিতে হবে। যারা ভাবেন সময়, তারা আরো চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সময়ের বরফ গলে পরিস্থিতি আরো জটিল করা ছাড়া কোনো লাভ হবে না।
নাগরিকরা নিশ্চিতভাবে মনে করে, এই সরকার জাতিকে পিছিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছু অর্জন করেনি।
তাই এখন পর্যন্ত অনৈতিক সংসদকে দীর্ঘ মেয়াদি না করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে মন্দের ভালো সংসদ তৈরিতে আয়োজনের ব্যবস্থা করুন।
অনেক কসরৎ হয়েছে, নাগরিকদের বুঝ দেয়া আর সম্ভব নয়, ঘুরে ফিরে একটি প্রশ্ন ছাড়া আর কোনো মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসছে না তা হলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।
এর মধ্যে দিয়ে নাগরিকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তবেই প্রচলিত রাজনীতি ধীরে-ধীরে পরিশুদ্ধ হয়ে আসবে। তাহলেই রাজনীতিকরা রাজনীতিকে রাজনীতির মতো চলতে দিয়ে ধীরে-ধীরে রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকতায় উত্তরণের পথ শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ১৬ কোটি নাগরিকের দেশে অস্বাভাবিক জুলুম নিপীড়ন করে তা সম্ভব নয়।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন: https://www.facebook.com/Polnewsbd/
লেখক : সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।